নিউ ইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জে যুক্ত পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ একটি পাবলিক ট্রেড কোম্পানি হলো অ্যাপেল ইনকর্পোরেশন। খেয়াল করুন আমি অ্যাপেলকে কিন্তু একটি টেক বা প্রযুক্তি কোম্পানি বলিনি। যেখানে হয়ত ভাবছেন বলার কথা ছিল টেক জায়ান্ট। হ্যা তা বলা যেত তবে এখন বাস্তবিক অর্থে আর বলা যাবে না,কেননা অ্যাপেল একটি প্রযুক্তি পণ্য কোম্পানি হতেই চায় না, অ্যাপেল ইনকর্পোরেশন হতে চায় একটি ডিজিটাল ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। তারা নিজেদের প্রযুক্তি কোম্পানি বলতে নারাজ!
২০১৯ সালের মার্চ মাসে একটি অনুষ্ঠানে অ্যাপেল সিইও টিম কুক অ্যাপেলের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে আভাস দেন। আর সে ইভেন্টে তার বক্তব্য থেকে বোঝা যায়, অ্যাপেল নেটফ্লিক্স, অ্যামাজন এবন ডিজনি এর মত কোম্পানির পথ অনুসরন করে তাদের বেশ কিছু নতুন সেবা নিয়ে আসবে।
অ্যাপেল বিশ্বব্যাপী বিখ্যাত তাদের নানারকম মানসম্মত ও অত্যাধুনিক হার্ডওয়্যার, কিন্তু তারা কেবল এই দিক দিয়ে অ্যাপেলকে পরিচালিত করুক। তারা কেবল একটি প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান হয়ে আর নিজেদের এগিয়ে নিতে চায়না। আর আজকের আর্টিকেলে এটাই জানবেন,কিভাবে অ্যাপেল একটি হার্ডওয়্যার কোম্পানি থেকে পরিণত হচ্ছে একটি ডিজিটাল সার্ভিস কোম্পানিতে।
২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসে অ্যাপেল সিইও টিম কুক, অ্যাপেল এর ইনভেস্টরদের একটি চিঠি পাঠান, সেই চিঠিতে তিনি যা উল্লেখ করেন, তা খুবই হতাশাজনক। তিনি সেখানে উল্লেখ করেছিলেন, ‘অ্যাপেল এর সবচেয়ে বড় পণ্য হল স্মার্টফোন, পার্সোনাল কম্পিউটার এবং ট্যাবলেট। তবে দিন দিন এই পণ্য গুলোর চাহিদা বাজারে তেমন বাড়ছে না। আর সার্বিক ক্ষতিপূরণ গুনতে অ্যাপেলকে পণ্যের দাম বাড়াতেই হচ্ছে। যার ফলে দেখা যাচ্ছে, আমরা ঠিক যে পরিমাণ মানুষ আইফোন কিনবে বলে ধারনা করছি, তার তুলনায় ক্রেতা সংখ্যা পরিমানে অনেক কম।’
তবে এটা স্বাভাবিক, অ্যাপেল তাদেরকে শীর্ষ স্থানে ধরে রাখতে কেবল তাদের জনপ্রিয় হার্ডওয়্যার খাত থেকে তারা সেই অবস্থানে যেতে পারবে না। এমনকি বিগত রিপোর্ট গুলো অ্যাপেলের হিসেবে সেই প্রমানই দেয়। আর এই অবস্থান থেকে বের হতে অ্যাপেলের ব্যবসায়িক খাত আরও বাড়াতে হবে। আর সেই বাড়ানোটা বস্তুগত ভাবে বিভিন্ন দেশে নতুন নতুন ব্যবসা প্রতিষ্ঠা করে নয়, ডিজিটাল উপায়ে! আর অ্যাপেল সেই কাজ গুলোই করতে যাচ্ছে এবং ইতিমধ্যে শুরু করে দিয়েছেও।
যদিও অ্যাপেল এর মত কোম্পানির থেকে এটা মোটেও একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ নয়। তবে ব্যবসায়িক সমৃদ্ধির বিচারে ডিজিটাল সার্ভিসেস এর বাজারে প্রবেশ তাদের নতুন একটি অর্থনীতিক উন্নতিতে নিয়ে আসতে পারে, যা আমরা দেখতে পাই অ্যামাজন এর দিকে তাকালে। আমরা অ্যামাজন’কে জানি একটি বৃহৎ ইকমার্স প্লাটফর্ম হিসেবে, কিন্তু তারা তাদের ডিজিটাল সার্ভিসেস এর সবকিছু বিক্রি করে তাদের আমাজন প্রাইম এর ব্যানারে।
অ্যাপেল এর সবচেয়ে ভালো দিক হল, তাদের হার্ডওয়্যার এবং সফটওয়্যার ইকোসিস্টেম সবকিছুই এক ছাদের নিচে। তারা সফটওয়্যার ইকোসিস্টেম এবং হার্ডওয়্যারে কারো উপর নির্ভরশীল নয়। এখানে অ্যাপেল ডিভাইস এর কাস্টমার সাপোর্ট এর জন্য রয়েছে অ্যাপেল কেয়ার, ফোনের স্টোরেজ শেষ হয়ে গেলে রয়েছে অ্যাপেল আইক্লাউড, তাছাড়াও তাদের রয়েছে ৫০ মিলিয়ন নিবন্ধনসমৃদ্ধ অ্যাপেল মিউজিক। এইসব বিষয়ে অ্যাপেল সিইও টিম কুক পুরোপুরি ভাবে অনুসরণ করছেন আমাজন প্রতিষ্ঠাতা জেফ বেজস’কে। আপনি কি ভাবছেন অ্যাপেল এর টিম কুকের নতুন এসব পদক্ষেপ অ্যাপেলকে কেবল একটি ডিভাইস ম্যানুফ্যাকচারার টেক কোম্পানি হিসেবে প্রমান করছে?
আমরা যদি অ্যামাজন প্রাইম এর উদাহরন দেই, অ্যামাজন প্রাইম কি? অ্যামাজন প্রাইম অ্যামাজনের একটি বিশেষ সেবা যেখানে গ্রাহক মাসিক নির্দিষ্ট টাকা দিয়ে সাবস্ক্রিবসন কিনে রাখলে সে সস্তা এবং খুবই দ্রত পণ্য ডেলিভারি পাবে। কিন্তু পরে জেফ বেজস কি করল? তিনি এই অ্যামাজন প্রাইমের ভেতর মিউজিক, ভিডিও স্ট্রিমিং, ইবুক এবং ইমেজ স্টোরেজ সেবা ঢুকিয়ে দিলেন। যা অ্যামাজনকে একটি ইকমার্স কোম্পানি থেকে বের করে নিয়ে এসে ডিজিটাল সার্ভিসেস কোম্পানিতে রূপান্তরিত করল! এমনকি তারা বিভিন্ন ইন্টারনেট সেবা দেয়ার জন্য চালু করল অ্যামাজন ওয়েব সার্ভিসেস। এসব করে তারা কেবল একটি ইকমার্স কোম্পানি থেকে বের হয়ে এসে, পরিণত হল একটি পরিপূর্ণ ব্যবসায়িক কোম্পানিতে।
তো এখন আসুন দেখি অ্যাপেলের টিম কুক সাহেব কি করেছিলেন? টিম কুক ২০১৫ সালে চালু করেন একটি বিশেষ সেবা সেটার নাম হচ্ছে আইফোন আপগ্রেড প্রোগ্রাম। যেখানে কি হবে? ব্যবহারকারিরা একটি মাসিক ফি দিবে, যার ফলে তারা প্রতিবছর যে লঞ্চ হওয়া নতুন আইফোন পাবে। এই প্রোগ্রামটি আইফোনকে একটি সার্ভিসে রূপান্তর করল। এখানে ব্যবহারকারীরা আইফোনের মালিকানা পাওয়ার পরিবর্তে আইফোন একরকম ভাড়া পেল। আর অ্যাপেলের এরকম প্রোগ্রামকে আমরা খুব সহজেই অ্যামাজন প্রাইমের মত ‘অ্যাপেল প্রাইম’ হিসেবে তুলনা করতেই পারি!
বর্তমানে অ্যাপেল আরো অনেক সার্ভিস তার ব্যবহারকারীদের অফার করছে। আর এই সকল সার্ভিসকে সর্বোচ্চ এগিয়ে নিয়ে যেতে টিম কুক তার সাধ্যমত চেষ্টা করে যাচ্ছেন। অ্যামাজন প্রাইমের আরেকটি সার্ভিস যা অ্যাপেল সিইও কে অনুপ্রাণিত করেছিল, তা হচ্ছে অ্যামাজন প্রাইম ভিডিও। আর প্রাইম ভিডিও থেকে অনুপ্রাণিত হতে অ্যাপেল সিইও তাদের অ্যাপেল টিভি+ নিয়ে বেশ তোরজোড়ের সাথে কাজ করে যাচ্ছেন।
তবে আরেকদিক দিয়ে এই অ্যাপেল টিভি প্লাস ‘অ্যামাজন প্রাইম ভিডিও’ থেকে অনুপ্রাণিত হলেও তারা ডিজনি+ এবং নেটফ্লিক্সের মত কনটেন্ট সার্ভিসের বাজারেও দাপট বাড়াতে চায়। অন্যদিকে আরেকটি যে বিষয় অ্যাপেলকে একটি পুরোদমে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান হিসেবে আখ্যায়িত করে তা হচ্ছে অ্যাপেল ক্রেডিট কার্ড।
অ্যাপেল ক্রেডিট কার্ডটি অ্যাপেল পে এর সাথে লিঙ্ক করা এবং আইফোনের ওয়ালেট অ্যাপ দিয়েই এর সবকিছু তদারকি করা সম্ভব। এই কার্ডটিকে অ্যাপেল পে এর জন্য বিশেষভাবে অপ্টিমাইজড করলেও এটি কিন্তু সাধারন ক্রেডিট কার্ড হিসেবেও কাজ করে। আর তাদের কার্ডটি মাস্টারকার্ডএর সাথেও পার্টনারশিপে আছে তাই নিঃসন্দেহে এই কার্ড পৃথিবীর যেকোনো মাস্টারকার্ড আউটলেটেও সাপোর্ট করবে।
তো পুরো আর্টিকেলটি পরে কি বুঝলেন? অ্যাপেলকে এখনও আপনি একটি প্রযুক্তি কোম্পানি বলবেন নাকি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান সেটা আপনিই ভেবে দেখুন।
You're reading eProjonmo, the versatile technology news portal of bd.