স্যাটেলাইট হচ্ছে এমন একটি বস্তু যা গ্রহকে ঘিরে একটি বক্রাকার চক্রপথে ঘুরতে থাকে। চাঁদ পৃথিবীকে কেন্দ্র করে এর চারপাশে ঘুরতে থাকে। চাঁদ হচ্ছে পৃথিবীর একটি প্রাকৃতিক উপগ্রহ। প্রাকৃতিক উপগ্রহের পাশাপাশি আরেকরকমের একটি উপগ্রহ রয়েছে, সেগুলোকে বলা হয় কৃত্রিম উপগ্রহ। এই সকল কৃত্রিম উপগ্রহ মানুষের দ্বারা তৈরি। প্রাকৃতিক উপগ্রহ যেখানে গ্রহের থেকে অনেক দূরে অবস্থান করে, অন্যদিকে কৃত্রিম উপগ্রহ গ্রহের কাছে অবস্থান করে । কৃত্রিম উপগ্রহ প্রাকৃতিক উপগ্রহের মতন করেই গ্রহের চারপাশে একটি কক্ষপথকে কেন্দ্র করে ঘুরতে থাকে।
প্রাকৃতিক উপগ্রহের বাইরে মানবসৃষ্ট এই যত কৃত্রিম উপগ্রহ রয়েছে এগুলোকেই বলা হয় স্যাটেলাইট। নিউটনের সূত্র মতে মহাবিশ্বে যেকোনো দুটি বস্তুর মধ্যেই মাধ্যাকর্ষণ বিদ্যমান। আর স্যাটেলাইট গ্রহের সাথে মাধ্যাকর্ষণ বলের কারনে, গ্রহের কেন্দ্রমুখি মধ্যাকর্ষণ বলের আকর্ষণে যুক্ত থেকে গ্রহকে প্রদক্ষিণ করে এর সাথে তাল মিলিয়ে ঘুরতে থাকে।
স্যাটেলাইটের প্রকারভেদ
স্যাটেলাইট অনেক আকৃতির এবং আকারের হয়ে থাকে। আর একেক স্যাটেলাইটের কাজও একেকরকম। আমরা নিচে কিছু প্রকৃতির স্যাটেলাইট সম্পর্কে জানব,
আবহাওয়া স্যাটেলাইটঃ এই স্যাটেলাইট গুলো ব্যবহার করাহয় আবহাওয়ার গতি পর্যবেক্ষণ করবার কাজে। মূলত এগুলোকে বলা হয় জিওষ্টেশনারী অপারেশনাল এনভায়রনমেন্ট স্যাটেলাইট। এসকল স্যাটেলাইট ফিক্সড জিওষ্টেশনারী অবস্থান কিংবা পোলার অরবিট থেকে কেন্দ্র করে পৃথিবীর নির্দিষ্ট জায়গার উপর থেকে ছবি তুলে প্রেরন করে। আর সেই সকল ছবি থেকে আবহাওয়ার অবস্থা পর্যালোচনা করা হয়।
কমিউনিকেশন স্যাটেলাইটঃ মূলত টেলিফোন সংযোগ এবং ডাটা স্যাটেলাইটে রিলে করে যোগাযোগ রক্ষা করার কাজ যে স্যাটেলাইটগুলো করে, তাদেরকে বলা হয় কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট। টেলস্যাট এবং ইন্টেলস্যাটের মাধ্যমে কমিউনিকেশন স্যাটেলাইটের যাত্রা শুরু হয়। কমিউকেশন স্যাটেলাইটের মাধ্যমে প্রথম কম খরচে দ্রুততার সাথে আন্তমহাদেশীয় টেলিফোন সংযোগ চালু হয়। বর্তমানে কমিউনিকেশন স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ইন্টারনেট সংযোগও ট্রান্সমিট করা হচ্ছে।
ব্রডকাস্ট স্যাটেলাইটঃ ব্রডকাস্ট স্যাটেলাইটগুলোর মাধ্যমে মূলত টেলিভিশন চ্যানেলের সিংনাল গুলো ট্রান্সমিট করা হয়।
বৈজ্ঞানিক স্যাটেলাইটঃ বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক গবেষণামূলক কাজে এই সকল স্যাটেলাইটগুলো ব্যবহার করা হয়। যেমনঃ হাবল স্পেস টেলিস্কোপ পৃথিবীর সবচাইতে বড় বৈজ্ঞানিক স্যাটেলাইট। আর এই হাব্ল স্পেস টেলিস্কোপ মহাকাশে গামা রের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে, আর বিজ্ঞানীরা এটি নিয়ে গবেষণা করেন।
ন্যাভিগেশন স্যাটেলাইটঃ এগুলো স্যাটেলাইট প্রধানত সমুদ্রে জাহাজে চলার পথ নির্ধারণ করতে সহযোগিতা করে। তাছাড়া জিপিএস প্রযুক্তি তথা গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম প্রযুক্তি কাজ করার পেছনে মুখ্য ভূমিকা পালন করে এসব ন্যাভিগেশন স্যাটেলাইট।
রেসকিউ স্যাটেলাইটঃ রেসকিউ বা উদ্ধার স্যাটেলাইট রেডিও ডিস্ট্রেস সিংনাল ব্যবহার করে হারিয়ে যাওয়া বিপদে পড়া মানুষ বা কিছুকে খুঁজে পেতে সহযোগিতা করে থাকে।
আর্থ অবজারবেশন স্যাটেলাইটঃ এই স্যাটেলাইট গুলো মূলত পৃথিবীর গতিবিধি লক্ষ্য করে। পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি থেকে শুরু করে , মেরু অঞ্চলের বরফ গলা সবকিছুই এই স্যাটেলাইট খুব ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে।
সামরিক স্যাটেলাইটঃ এই স্যাটেলাইটগুলো অনেক জটিল জটিল এবং স্পর্শকাতর কাজের জন্য ব্যবহার করা হয়। নিউক্লিয়ার মনিটরিং থেকে শুরু করে কমিউনিকেশন এনক্রিপশন এসকল কাজ এসব মিলিটারি বা সামরিক স্যাটেলাইট দিয়ে করা হয়ে থাকে। বর্তমানে সামরিক স্যাটেলাইটের সবচাইতে বড় বড় কাজ হচ্ছে, শত্রুর গতিবিধির উপরে নজর রাখা।
নিউটনও হয়ত মহাকাশে কৃত্রিম স্যাটেলাইটের মত কিছু পাঠানোর কথা তার মনে চিন্তা করেছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে নিউটন হয়ত সেটি কখনও প্রকাশ করতে পারেননি বা উঠে আসেনি। তবে, এই স্যাটেলাইটের প্রথম ধারণা উঠে আসে সাইন্স ফিকশন রাইটার আর্থার ক্লার্কের লেখায়। ১৯৪৫ সালে আর্থার ক্লারক তার একটি লেখায় স্যাটেলাইটের ধারণা দিয়ে লেখেন যে, এমন একটি বস্তু মহাকাশে কক্ষপথে সেট করে দেয়া যেতে পারে; জেন সেটি পৃথিবীর আহ্নিক গতির সাথে মিলিয়ে একই দিকে পৃথিবীর একই স্থানের সাথে থেকে ঘুরতে পারে। এটা ছিল মূলত জিওষ্টেশনারী স্যাটেলাইটের ধারণা। আর্থার ক্লার্ক মূলত যোগাযোগ ব্যবস্থায় এক দারুন বিপ্লব আনবার জন্য স্যাটেলাইট ব্যবহারের ধারণা দিয়েছিলেন।
প্রথম স্যাটেলাইটের উদ্ভাবন
তখনও বহু বিজ্ঞানি আর্থার ক্লার্কের কথাকে ততটা গুরুত্ব দেয়নি। কিন্তু বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়নি! সবার টনক নড়ে, যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন তাদের স্পুটনিক ১ স্যটেলাইট তৈরি করে সেটিকে মহাকাশে প্রেরন করে। স্পুটনিক ১ ছিল মূলত ২৩ ইঞ্চি লম্বা এবং ৮৩ কেজি ওজনের একটি মেটাল বল। স্পুটনিক ১ আকাশে ওঠার পর থেকে সকল দিকে স্যাটেলাইট নিয়ে গবেসনার হিরিক ওঠে!
স্পুটনিক ১ স্যাটেলাইটের মধ্যে ছিল,
- থার্মোমিটার
- ব্যাটারি
- রেডিও ট্রান্সমিটার
- নাইট্রোজেন গ্যাস
স্পুটনিক ১ মেটাল স্যাটেলাইটটি ভিতর থেকে ছিল নাইট্রোজেন গ্যাসে পরিপূর্ণ। স্যাটেলাইটিতে ছিল একটি রেডিও ট্রান্সমিটার, যা তাপমাত্রা পরিবর্তনের সাথে সাথে পরিবর্তিত সাউন্ড বিপ পৃথিবীতে প্রেরন করত।
স্পুটনিকের বাইরে ছিল একটি সাদা ৭ মেগাহার্টজের এন্টেনা। যেই এন্টেনা প্রাপ্ত ডাটা রেডিও সিংনালের মাধ্যমে পৃথিবীতে প্রেরন করত। পৃথিবীতে থাকা গ্রাউন্ড ষ্টেশন সেই এন্টেনা থেকে প্রাপ্ত রেডিও সিংনাল থেকে বুঝতে পেত যে ছোট্ট স্যটেলাইটটি মহাকাশে দারুনভাবে সারভাইভ করছে এবং টা কক্ষপথের সাথে মিল রেখে পৃথিবীকে প্রদক্ষিন করছে।
সফলভাবে স্পুটনিক ১ মহাকাশে প্রেরন করার পর পরই সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রথম প্রানি সহকারে স্পুটনিক ২ স্যাটেলাইট মহাকাশে প্রেরন করে। আর স্পুটনিক ২ স্যাটেলাইটে বিদ্যমান প্রানিটি ছিল একটি কুকুর, আর সেই কুকুরটির নাম ছিল লাইকা।
তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের স্যাটেলাইট প্রযুক্তিতে সফলতার পরে আমেরিকাও স্যাটেলাইট প্রযুক্তিতে বেশ তোর-জোরের সাথে গবেষণা শুরু করে। আমেরিকা তাদের প্রথম স্যাটেলাইট পাঠায়, যার নাম ছিল এক্সপ্লোরার ১। এক্সপ্লোরার ১ স্যাটেলাইটটি ছিল একটি বৈজ্ঞানিক স্যাটেলাইট। এটিকে মূলত মহাকাশের কসমিক রে গণনার জন্য প্রেরন করা হয়েছিল।
ধীরে ধীরে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোও স্যাটেলাইটের গুরুত্ব উপলব্ধি করে, স্যাটেলাইট ব্যবহার করে বড় বড় প্রযুক্তিগত সমাধান করবার কাজ শুরু করে। এই প্রথম ১৯৪৫ সালের আর্থার ক্লার্কের স্যাটেলাইট কনসেপ্টকে মাথায় নিয়ে হুগস এয়ারক্রাফট এবং ইঞ্জিনিয়ার হারল্ড রোসেন স্যটেলাইট ডেভেলপ শুরু করে। তারা একটি কমিনিকেশন স্যাটেলাইট পৃথিবীর কক্ষপথে প্রেরন করে, যা দিয়ে এক স্থানের রেডিও সিংনাল অন্য স্থানে প্রেরন করা যেত।
হুগস এয়ারক্রাফটের এই সফলতা দেখে তৎকালীন আমেরিকার নাসা তাদের সিনকম স্যাটেলাইট তৈরির জন্য চুক্তি করে। এরপরে পরপর সিনকম ১ এবং সিনকম ২ এর পরে, সিনকম ৩ ছিল তাদের তৈরি প্রথম জিওষ্টেশনারি স্যাটেলাইট যা দিয়ে টেলিভিশন ভিডিও সম্প্রচার করা সম্ভব হয়। এর আগে সিনকম ২ স্যাটেলাইট দিয়ে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট কেনেডি প্রথম স্যটেলাইট সিস্টেম ব্যবহার করে আন্তমহাদেশীয় যোগাযোগ হিসেবে নাইজেরিয়ার প্রধান মন্ত্রীর সাথে কথা বলেন।
স্যাটেলাইটের ভিতরে কি থাকে?
স্যাটেলাইট একেক আকার এবং আকৃতির হয়ে থাকে। আকার আকৃতির পাশাপাশি আবার একেক স্যাটেলাইটের কাজও একেকরকম হয়ে থাকে। তবে সকল স্যাটেলাইটে কিছু জিনিস থাকে কমন। আমরা সেই কমন জিনিসগুলি কি থাকে একটি স্যাটেলাইটে সেগুলো সম্পর্কে জানব,
- সকল স্যাটেলাইট মেটাল কিংবা মেটাল কম্পোজিট ফ্রেমে তৈরি । আর এই সকল ফ্রেমকে বলা হয় Bus। এই বাস স্যাটেলাইটটিকে বিভিন্ন প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকবার মতন শক্তিশালী রূপে টিকিয়ে রাখে।
- সকল স্যাটেলাইটের মূল বিদ্যুৎ সোর্স হচ্ছে ব্যাটারি। প্রতিটি স্যাটেলাইট তার ভিতরে থাকা ব্যাটারি থেকে পাওয়ার লাভ করে, আর সেই সকল ব্যাটারি চার্জ করার জন্য স্যাটেলাইটের সাথে সোলার প্যানেল যুক্ত থাকে। তবে বর্তমানে কিছু স্যাটেলাইট তৈরি হচ্ছে সেগুলো নিউক্লিয়ার ক্ষমতাসম্পন্ন ফুয়েল সেলে তৈরি। যেখানে নিউক্লিয়ার বিক্রিয়ার মাধ্যমে অনন্ত সময়ের জন্য বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়। তবে ফুয়েল সেল সমৃদ্ধ স্যাটেলাইট অনেক বেশি দামি আর এগুলো সংখ্যাতেও অনেক কম। অন্যান্য গ্রহে গবেষণার জন্য যেসব স্যাটেলাইট পাঠানো হয়, সেগুলোর গায়ে এমন ফুয়েল সেল যুক্ত করে দেয়া থাকে।
- প্রতিটি স্যাটেলাইটে একটি কম্পিউটার বোর্ড যুক্ত করা থাকে, যে বোর্ডটি স্যাটেলাইটের সকল প্রকার সিস্টেমের হিসাব নিকাশ সমন্বয় করে।
- সকল স্যাটেলাইটে একটি রেডিও সিস্টেম যুক্ত করা থাকে। সেই সিস্টেমের মাধ্যমে রেডিওটি গ্রাউণ্ডে তথ্য প্রেরন করতে পারে। অনেক স্যটেলাইটে রেডিও রিসিভারও বিদ্যমান থাকে, যার ফলে গ্রাউন্ড থেকে প্রাপ্ত
- যেকোনো রিকুয়েস্ট স্যাটেলাইটটি প্রসেস করতে পারে। রেডিও রিসিভারের মাধ্যমে অনেক সময় স্যাটেলাইটকে নিয়ন্ত্রন করা যায়, এমনকি অনেক সময় স্যাটেলাইটের সম্পূর্ণ কম্পিউটার সিস্টেমও রি-প্রোগ্রাম করা যায়।
- সকল স্যাটেলাইটে ACS – এটিটিউড কন্ট্রোল সিস্টেম থাকে। এসকল এটিটিউড কন্ট্রোল সিস্টেমের মাধ্যমে স্যাটেলাইট ঠিক দিকে চলতে থাকে।
আর স্বাভাবিকভাবেই স্যাটেলাইটে এতকিছু ঢুকিয়ে দেয়া মোটেও সহজ কোন কাজ নয়। এটিকে সম্পন্ন করতে বছরের পর বছর লেগে যায়। সকল কিছুই বিবেচনা করা হয় এটা ভেবে যে ঠিক কোন মিশনের জন্য এই স্যাটেলাইটকে মহাকাশে পাঠানো হচ্ছে। সবকিছু বিবেচনা করে ইঞ্জিনিয়াররা ঠিক করেনযে , ঠিক কিভাবে কোন কোন পার্টস তারা স্যাটেলাইটের মধ্যে কিভাবে সাজাবেন। সকল ম্যাপিং সম্পন্ন হলে এবং স্যাটেলাইট তৈরির জন্য বাজেট পাশ হলেই সেই স্যাটেলাইটের উৎপাদন করা শুরু হয়। খুবই নীরব, শান্ত, সঠিক তাপমাত্রা সম্পন্ন রুমে খুবই যত্নের সাথে স্যাটেলাইটকে তৈরি করা হয়।
You're reading eProjonmo, the versatile technology news portal of bd.